এই বাংলাদেশ কী চেয়েছিলাম! —অনুপম ফকির—

তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে!
বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে যুদ্ধে যাবেন।
একদিন সকালে মাকে এসে বললেন, ‘আমি যুদ্ধে যেতে চাই।’
মা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘তোর বাবাকে বল। কিছু সময় চুপ করে থাকার পর তাঁর বাবা বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে যাবি যা, কিন্তু দেশ স্বাধীন করে তবে ঘরে ফিরবি।’
চলে গিয়েছিলেন যুদ্ধে!
ছিলেন নগর গেরিলা।
ফিরেছেন দেশ স্বাধীন করে।
ক্যাম্পে তার গান শুনতে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা এসে ভিড় করতো।
থালা বাসন বাজিয়ে গানে সুর তুলতেন।

ছবি: ১৯৭২ সালে কোনো এক আড্ডায় শিল্পী আজম খান ( বাম দিক থেকে প্রথম)
যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তার নিজের জগতে ফিরে গেলেন।
১৯৭২ সালে বিটিভিতে গিটার, ড্রাম নামের অদ্ভুত সব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে হাজির হলেন।
এসব যন্ত্র এ দেশের মানুষ এর আগে কোনোদিন দেখেনি।
পর্দায় উত্তম সুচিত্রার ”তুমি যে আমারে” বুঁদ হয়ে থাকা প্রজন্ম দেখলো একটা টিংটিংয়ে লম্বা ছেলে নেচে নেচে গাইছে, ”আলাল আর দুলাল, আলাল আর দুলাল।”
বেশিরভাগ বললেন এসব আবার কি?
কিন্তু এরপর শুধু ইতিহাস!
একাত্তরে যার বন্দুক বেজেছিল গিটারের মত আর তারপরে যার গিটার বেজেছিল বন্দুকের মত।
তিনি এক ভিন্ন ধারার গানে বুঁদ করে ফেললেন গোটা একটা প্রজন্মকে। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠলো ব্যান্ড!
লম্বা চুল হয়ে উঠলো ফ্যাশন!
সে কিন্তু তার গানে আজব কোনো কথা বলছেনা!
যুদ্ধ শেষে এক বিধ্বস্ত জনপদ নিয়ে গান গাইছে সে।
বলছে, ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে, জন্মেছিল একটি ছেলে, মা তার কাঁদে, ছেলেটি মরে গেছে!”
আবার সেই একই লোক বলে, ”কিছু বলো, একটা কিছু, চুপ করে থেকোনা।”
আবার কমলাপুরের বাসার উপর তলায় ভাড়া থাকা পাঁপড়ির প্রেমে পড়ার পর যখন প্রেমিকা বললো, চলো পালিয়ে যাই। কিন্তু চাইলেইতো আর হয়না। পাঁপড়ির মা টের পেয়ে গেল।ঘরে তালা পড়লো।
প্রেমিকার সাথে দেখা না করতে পারা বিরহী প্রেমিক গাইলো “সারা রাত জেগে জেগে, কত কথা ভাবি আমি, পাঁপড়ি কেনো বুঝে না, তাইতো ঘুম আসে না।”
গত কয়েক দিন ধরে কেনো জানিনা, আমি আজম খানের কথা ভাবছিলাম। ওনার গান শুনছিলাম।
এর মধ্যে একটা ভিডিও দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো!
একটা স্টেজ শোতে আইয়ুব বাচ্চুর সাথে পারফর্ম করছিলেন।
বাংলাদেশ গানটা গাইছিলেন।
মুখরাটা গেয়ে বাচ্চুকে ডেকে বললেন, ”বাচ্চু গা।”
এরপর দুজনে যখন এক সাথে ”বাংলাদেশ…বাংলাদেশ” বলে গেয়ে উঠেন, যতবার সেই দৃশ্যটা আমি দেখি, আমার চোখ ভরে উঠে নোনা জলে! আমার মনে পড়ে, এই ২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর আজ পর্যন্ত কেউ সালেকা, মালেকার কথা বললোনা! বললো না, রেল লাইনের বস্তিতে যে শিশুটা আজ জন্ম নিলো তার কথাও! সবাই মিলে ভাঙচুর করলো, হত্যা করলো, ছিনতাই, ডাকাতি ধর্ষণ- সব করলো!
সিন্ডিকেট কেউ ভাংতে গেল না!আমেরিকায় মোদির নামে শ্লোগান হল, বেশি দামের চাল নিয়ে দেশে এসে ভিড়ল হানাদার পাকিস্তানের জাহাজ! ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে কাওয়ালি হলো, দামা দাম মাস্ত কালান্দার ডাকে রব উঠল,পাকিস্তানের শিল্পীরা গান গেয়ে কোটি টাকা নিয়ে গেল আর আমার দেশের শিপ্লীরা এখন ভয়ে জংগলে পালায়!
ক্রিকেটাররা টাকা পায় না!
জয় বাংলা হয়ে গেলো ইনকিলাব জিন্দাবাদ…!
পাকিস্তান আর ভারতের চাপে,তাপে,প্রভাবে,পন্থীদের হুংকারে হারিয়ে গেল আমার দেশ।
বাংলাদেশ!
এতো কথা হলো শুধু বাংলাদেশ গড়ার কথা কেউ বললোনা!
আমি রাজাকার আর ভাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ চাই!
তাই আমাদেরকে সেই আজম খানদের কাছেই ফিরে যেতে হয় বারবার।
আমাদের আবার হয়ে উঠতে হবে এক একজন আজম খান!
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
(মতামতের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়)