আত্মপ্রকাশ করলো এনসিপি (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি )। বেশ কিছুদিন ধরে চলা জল্পনা ও রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দলটি গঠিত হলো। দলটির নাম দেওয়া হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি, ইংরেজিতে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি, সংক্ষেপে এনসিপি। গত কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমে দলটির নাম ও শীর্ষ নেতৃত্বের তালিকা প্রকাশ হতে থাকে, যা আত্মপ্রকাশের দিনেও প্রায় অপরিবর্তিত রয়ে যায়। দলের আহ্বায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয় নাহিদ ইসলামকে এবং সদস্য সচিব হিসেবে আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করা হয়।
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার কথা ছিল বিকেল তিনটায়, তবে তা শুরু হয় সাড়ে চারটায়। চার ধর্মের ধর্মগ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। নতুন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান বিকেল পাঁচটার দিকে। এর আগে, আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এবং জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তারা নতুন দলটিকে স্বাগত জানানোর কথা বলেন এবং এর সাফল্য কামনা করেন।
দুইদিন আগে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক (সাবেক) সারজিস আলম বলেছিলেন, অন্তত দুই লাখ লোকের সমাগম ঘটিয়ে নতুন দল ও নেতাদের নাম ঘোষণা করতে চান তারা। তবে, অনুষ্ঠানে ততটা জনসমাগম হয়নি বলে ধারণা দেন একাধিক সংগঠক ও অনুষ্ঠান কাভার করতে আসা সাংবাদিকরা। তারপরও, নতুন দলের যাত্রা শুরুর দিনে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। দুপুর থেকেই অনুষ্ঠানস্থলে জড়ো হতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকেও অনেক নেতাকর্মী আসেন। চট্টগ্রাম থেকে আসা দুই কর্মী জানান, তারা প্রায় ৫০টি বাস ভর্তি করে এসেছেন কর্মসূচিতে যোগ দিতে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতরাও অনুষ্ঠানে সমবেত হন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সভার মঞ্চে সাধারণত চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা থাকে। তবে, নাগরিক পার্টির মঞ্চে সেসব রাখা হয়নি। নেতারা সবাই মঞ্চের মেঝেতেই বসেন। এটিকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন অনেকে।
বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের প্রতিক্রিয়া
‘ছাত্রদের দল’ গঠন নিয়ে বিএনপি বেশ কিছুদিন ধরেই সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করলেও আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে সাংবাদিকদের কাছে নতুন দলটির সাফল্য কামনা করার কথা বলেন বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, “একজন সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে আমি গৌরববোধ করছি, ছাত্ররা একটি জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন করছে।” তরুণদের ভাষা ও বোঝাপড়াকে ব্যতিক্রম বলে রুহুল কবির রিজভী উল্লেখ করেন।
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে স্বাগত জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ খোলা থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, “আলাপ-আলোচনার পথ সবসময়ই খোলা থাকে। নতুন দলের ক্ষেত্রেও সেই সম্ভাবনা থাকবে।”
দলের নেতৃত্ব ও লক্ষ্য
দলের আহ্বায়ক পদে আছেন নাহিদ ইসলাম। সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়কের দুটি পদে আছেন সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব। সদস্য সচিব পদে আছেন আখতার হোসেন এবং সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিবের দুটি পদে তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিবা। দলের মুখ্য সংগঠক পদে আছেন তিন জন: মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ এবং মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক পদে আছেন আব্দুল হান্নান মাসউদ।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে বারবার বাংলাদেশে একটি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বা ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “২০২৪ সালের অভ্যুত্থান সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদেরকে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।”
নাহিদ ইসলাম সেকেন্ড রিপাবলিকের রূপরেখা তুলে ধরে বলেন, “জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য।” তিনি আরও বলেন, “শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল, যাতে করে জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়।”
বক্তব্য শেষ করার সময় নাহিদ ইসলাম সবাইকে সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনের প্রতিজ্ঞা করছেন কিনা, সে প্রশ্ন রাখেন। এরপর “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”, “ক্ষমতা না জনতা, জনতা জনতা”, “দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ” এমন নানা স্লোগান দেন দলের শীর্ষ নেতারা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দলটি ক্ষমতায় যেতে না পারলেও সাধারণ মানুষের অধিকার ও সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, এই নতুন দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় এবং তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কতটা সফল হয়।